গিবত কি বিভিন্ন ধরনের গিবত ও গিবতের ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
তোমরা পরস্পরের গুপ্তচরবৃত্তি ও গিবত কর্মে লিপ্ত হয়ো না। তোমাদের মধ্যে কী কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? নিশ্চয় তোমরা তা ঘৃণা করো।'গিবতের ভয়াবহতার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের এ কঠোর বক্তব্য ছাড়াও হাদিসে গিবত সংক্রান্ত বহু উক্তি রয়েছে। 


ভুমিকা

হযরত আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

যে ব্যক্তি দুনিয়াতে নিজের ভাইয়ের গোশত খেয়েছে গিবত করেছে। আখেরাতে তাকে গিবতাকারীর সামনে তাই ভাইয়ের গোশত উপস্থাপন করা হবে। তাকে আদেশ করা হবে, যেভাবে দুনিয়ায় তুমি তার গোশত খেয়েছো গিবত করেছো, এখনও অনুরূপভাবে তার গোশত খাও। গিবতকারী সে গোশত মুখে যে নিতেই তার মুখ বিকৃত হবে, আর এতে সে অপমানিত হবে।

গিবত কি?

শরিয়তের দৃষ্টিতে গিবত হলো কারো অনুপস্থিতিতে তার এমন কোনো দোষ-গুণ বর্ণনা করা, যা সে শুনলে কষ্ট পাবে। চাই সে মুখের দ্বারা তার গিবত করুক, অথবা কলমের দ্বারা কিংবা কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা অথবা অন্যকোনো পদ্ধতিতে এটি গিবত হিসেবে বিবেচিত হবে। সমালোচিত ব্যক্তি চাই মুসলিম হোক বা কাফের হোক, সেটা গিবত হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

উম্মুল মুমিনিন হযরত সালামা রাদি.-এর বেঁটে হওয়া (আততারগিব ওয়াততারহিব)

উম্মুল মুমিনিন হযরত সালামা রাদি, ছিলেন একটু বেঁটে আকৃতির। তাঁর এ বেঁটে হওয়া নিয়ে অন্য স্ত্রী হাসাহাসি শুরু করলে আল্লাহ তায়ালা অহি নাযিল করেন-

হে মুমিনগণ। কোনো পুরুষ যেনো কোনো পুরুষকে নিয়ে হাসাহাসি না করে, হতে পারে সে হাসাহাসিকারীর চাইতে উত্তম এবং কোনো মহিলা যেনো অপর কোনো মহিলাকে নিয়ে হাসাহাসি না করে, হতে পারে সে হাসাহাসিকারিণীর চাইতে উত্তম।

সমুদ্রের পানি কালো হয়ে যেতো

একবার হযরত আয়েশা রাদি. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসুল! সাফিয়্যাহ বেঁটে আকৃতির মেয়ে, তা সত্ত্বেও আপনি তাকে ভালোবাসেন?' একথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা কালো হয়ে গেলো। তিনি বললেন, 'আয়েশা! তুমি আজ এমন একটি কথা বলেছো, যা। সমুদ্রের পানিতে মেশালে পানি কালো হয়ে। যেতো।

প্রবৃত্তির দমন

হযরত ইবরাহিম বিন আদহাম রহ. একদিন জনৈক ব্যক্তির বাড়িতে মেহমান হলেন। খাবার মজলিসে বসে উপস্থিত লোকজন একব্যক্তির নাম করে বললো, 'অমুক আসেনি।' তারপর উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন বললো, 'সে স্থূলকায়, তাই আসতে দেরি হচ্ছে।' একথা শুনে হযরত ইবরাহিম বিন আদহাম রহ. না খেয়েই উঠে চলে গেলেন। নিজেকে নিজে বললেন, 'তোমার কারণে। আজ আমাকে গিবত শুনতে হলো। কেননা তুমি। ক্ষুধার্ত না হলে আমাকে দাওয়াতে আসতে হতো না এবং গিবতও শুনতে হতো না।' এরপর তিন দিন পর্যন্ত তিনি কোনো খাদ্য গ্রহণ করেননি। প্রবৃত্তিকে যথেষ্ট কষ্ট দেন।(সুনানে আবু দাউদ)

তোমরা কেবল কুকুরটির দোষই দেখলে

একদিন হযরত ইসা আলাইহিস সালাম সঙ্গী সাথিদের সাথে পথ চলছিলেন। চলার পথে তাঁরা। দুর্গন্ধময় একটি মরা কুকুর দেখতে পেয়ে দুর্গন্ধে নাক সিটকালেন। তখন হযরত ইসা আলাইহি সসালাম বললেন, 'কুকুরটির দাঁতের শুভ্রতা কেমন ভালো লাগছে, যেনো অন্ধকারে ভোরের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। একথা বলে তিনি সঙ্গীদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে, তোমাদের উপর তাজ্জব হলাম। তোমরা কুকুরটির দোষ তো দেখতে পেলে, কিন্তু সেটির সুন্দর দিকটা দেখলে না। কারো খারাপগুণের পাশাপাশি ভালোগুণও থাকে, সুতরাং ভালো গুণগুলোও দেখতে হয়। (তাম্বিহুল গাফিলিন)

আরো পড়ুন: পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ অঙ্গ, কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করবেন সেই সম্পর্কে ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত 

পোশাক-পরিচ্ছদের গিবত

দৈহিক গঠন-আকৃতির পর দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে, কারো পোশাক-পরিচ্ছদের গিবত করা। যেমন এরূপ বলা, অমুক অত্যন্ত কৃপণ, কৃপণদের মতো পোশাক পরিধান করে। অমুকে হারাম পোশাক যেমন রেশমি কাপড় অথবা দুষ্ট বদমাশ প্রকৃতির লোকদের মতো অঙ্গরাখা পরিধান। করে, অথবা তার পাজামা টাখুনর নিচে ঝুলে থাকে। অমুক মেয়েলোক এভাবে দোপাট্টা জড়িয়ে থাকে যে, তার সতর খোলা থাকে, অথবা জামা- ব্লাউজ এমনভাবে পরিধান করে যে, পেট-পিঠ দেখা যায়, অথবা অমুক মেয়েলোক এমনভাবে চলে যে, মানুষ তার সতর দেখতে পায় এগুলো সবই গিবত।

ইশারার মাধ্যমে গিবত করা

একবার উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রাদি. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বসে আলোচনা করছিলেন। কথায় কথায় উম্মুল মুমিনিন হযরত সুফিয়া রাদি.-এর কথা উঠলো। সতীনদের মাঝে পারস্পরিক একটু টানাপড়েন থাকা যেহেতু অস্বাভাবিক নয় আর হযরত আয়েশা রাদি.ও এ দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না, তাই তিনি হযরত সুফিয়া রাদি.-এর কথা আলোচনা করতে গিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে ইশারা করলেন। এর দ্বারা হযরত আয়েশা রাদি.-কে সম্বোধন কলে বললেন, 'হে আয়েশা! আজ তুমি এমন একটি অন্যায় করেছো, যার দুর্গন্ধযুক্ত বিষ কোনো সাগরে নিক্ষেপ করা হলে সমস্ত সাগর দুর্গন্ধ হয়ে যাবে।'

ভেবে দেখুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইঙ্গিতমূলক গিবতের ভয়াবহতা কীভাবে তুলে ধরলেন! অতঃপর তিনি বলেছেন, কেউ যদি আমাকে সারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ দিয়ে দেয় এবং এর বিনিময়ে কারো প্রতি বিদ্রূপ করে তার নকল করতে বলে, যার দ্বারা উদ্দেশ্যে হয়, ওই ব্যক্তির বিদ্রূপ ও বদনাম ছড়ানো, তথাপি আমি কাজটি করতে প্রস্তুত নই।

বংশের গিবত

কাউকে তুচ্ছ বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে যদি কেউ বলে, অমুক ব্যক্তি, অমুক বংশ অথবা অমুক শহরের লোকদের বংশধারা ভালো নয়। কেননা, তাদের বাপ-দাদা পূর্বপুরুষ হীন বংশীয় ছিলো, অথবা তাদের বংশধারা অজ্ঞাত, এতেও গিবত হবে। (তিরমিযী শরিফ, হাদিস নং ২৬২৪)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

'দীন এবং নেক আমল ব্যতীত কারো উপর কারো কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।'

অতএব, নিজের বংশ গৌরব প্রকাশ এবং অন্যের বংশের দোষ বর্ণনা, হেয় তুচ্ছ সাব্যস্ত করা নিতান্ত নিকৃষ্ট স্বভাব।

অভ্যাস কিংবা আচার-ব্যবহারের গিবত

অমুক ব্যক্তি খুবই অলস, অপদার্থ, সন্দেহপ্রবণ, অকর্মণ্য, অত্যন্ত নিদ্রাকাতর, পেটুক, উঠাবসায়- চালচলনে ভদ্রতা শালীনতা রক্ষা করে চলে না, কোনো বিষয়ের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করে না, নিতান্ত বেওকুফ, মেয়েলোকদের পরামর্শে চলে, সে স্ত্রীর অনুগমন করে চলে, অথবা মানুষদেরকে কষ্ট দেয় এ ধরনের সমালোচনাও গিবত।

এ সম্পর্কে কয়েকটি ঘটনা নিচে তুলে ধরছি

দুই সাহাবির ঘটনা

একবার হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদি. ও হযরত উমর রাদি. একত্রে সফরে ছিলেন। তাদের সঙ্গে এক খাদেমও ছিলো। সে সবসময় হযরত আবু বকর রাদি. ও হযরত উমর রাদি.-এর সেবা পরিচর্যা করতেন। পথিমধ্যে তাঁরা সফর বিরতি দিয়ে নিদ্রা গেলেন। তাঁদের পরে খাদেমও ঘুমিয়ে পড়েন। কোনো খাবারের ব্যবস্থা না করেই ঘুমি পড়ে। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে হযরত আবু বকর ও উমর রাদি. বললেন, 'লোকটা খুব বেশি ঘুমায়।' অতঃপর তাঁরা খাদেমকে জাগ্রত করে কিছু খাবারের জন্য হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে পাঠান। খাদেম গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর খেদমতে আরয করলো, 'হে আল্লাহর রাসুল! হযরত আবু বকর ও হযরত উমর রাদি, কিছু খাবারের জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন।' খাদেমের কথা শুনে হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'তারা দু'জন তো পরিতৃপ্ত। হয়েই খেয়েছে।' খবর পেয়ে তাঁরা উভয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে আরয করলেন, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ। আমরা আজ কী খেলাম?' রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'আজ তোমরা এ খাদেমের গোশত খেয়েছো। আমি তোমাদের দাঁতে গোশতের লালিমা দেখতে পাচ্ছি।' একথা শুনে তাঁরা নিবেদন করলেন, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন। আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন।' রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'শুধু আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করলেই এর থেকে মাফ পাওয়া সম্ভব নয়, বরং তোমাদের উচিত এ খাদেমকে সন্তুষ্ট করা। তোমরা তাকেই বলো, সে আল্লাহর দরবার থেকে তোমাদের অপরাধ মার্জনা করিয়ে নেবে।

একবার কোনো এক সাহাবি জনৈক লোকের আলোচনায় বললেন, 'সে এক আজব মানুষ, কেউ তাকে খাওয়াল তো খেলো, কেউ বাহনে আরোহণ করালো তো সে আরোহণ করলো, কিন্তু নিজে কোনো প্রকারে উপার্জন করতে পারে না।' এ আলোচনা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচক সাহাবাকে বললেন, 'তুমি আপন ভাইয়ের গিবত করলে?' সাহাবায়েকেরাম রাদি. আরয করলেন, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ! প্রকৃত দোষ বর্ণনা করাও গিবত?' রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'গিবত হওয়ার জন্য। প্রকৃত দোষ বর্ণনাই যথেষ্ট। (তাফসিরে দুররে মানসুর)

সরাসরি এবং অনুকরণজনিত গিবত

প্রথমত কারো নাম উল্লেখপূর্বক তার মন্দ বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করা, তার গিবত করা। দ্বিতীয়ত কারো মন্দ বৈশিষ্ট্যের অনুকরণ করা। যেমন-কেউ খোঁড়া হলে, হাঁটতে তার অনুকরণ করা-অন্ধের পিছনে চোখ বন্ধ করে চলা, কেউ বোবা বা তোতলা হলে তার অনুকরণ করা, কেউ কথা বলতে ঘাড় বা হাত হেলাতে অভ্যস্ত হলে নিজেও তার মতো করা, এ সবই অনুসরণজনিত গিবত।

এ জাতীয় গিবত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

'আমি কারো অনুকরণ পছন্দ করি না, যদিও আমি এক্ষেত্রে যথেষ্ট লাভবান হই।'

একবার হযরত আয়েশা রাদি. জনৈক মহিলার অনুকরণ করলে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

কারো থেকে অনেক ফায়েদা হাসিল হলেও আমি কারো অনুকরণ পছন্দ করি না।

আরো পড়ুন: যাকাত কি যাকাত না দেওয়ার পরিনতি যাকাত ফরজ হওয়ার কারণ স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত

ইঙ্গিতে গিবত করা

প্রকাশ্যে অথবা নাম উল্লেখ করা ছাড়াও এমন কিছু ইঙ্গিত রয়েছে, যাতে সবাই বুঝে নেয়, অমুকের দোষ বর্ণনা করা হচ্ছে এবং যে শব্দ বলা হচ্ছে তা দ্বারা অমুক ব্যক্তিই উদ্দেশ্য। যেমন-এরূপ বলা, আজ কিছু লোক আমার নিকট এসেছে, যারা এমন এমন। আর মানুষ বুঝে ফেলে, আজ তার নিকট কে কে এসেছে। এতে যারা বা যে তার নিকট এসেছে, সে বা তাদের গিবত করা হলো।

অথবা বলা হলো, কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা মূর্খ, জাহেল পণ্ডিত নামে প্রসিদ্ধ। উপস্থিত লোকেরা বুঝে ফেললো, সে কার কথা বলছে।মোদ্দাকথা হলো, এমন কোনো ইঙ্গিতমূলক কথা বলা যার দ্বারা লোকেরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চিনে। ফেলে। তাহলে এটি গিবত হবে। 

উপহাসমূলক গিবত

নির্দিষ্ট কারো আলোচনা করা হচ্ছে না, কিন্তু মানুষ। বুঝে যায় অমুকের কথা বলা হচ্ছে এও গিবত। যেমন, কারো আলোচনা আসলে বলা, 'আল্লাহর শোকর যে, তিনি আমাকে গোনাহগারের থেকে হিফাযত করেছেন।' তার একথা দ্বারা লোকেরা উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে চিনে ফেললো।

অথবা আলোচনার মাঝে বললো, 'আমি যিনাকারী নয়।' উদ্দেশ্য মানুষ আলোচিত ব্যক্তিকে যিনাকারী হিসেবে বুঝে নিক।অথবা বললো, 'দাড়ি কাটা খুবই খারাপ কাজ।' লোকেরা এতে বুঝে নিলো যে, কে দাড়ি কেটেছে। কারো সম্পর্কে এ ধরনের আলোচনা করাও গিবত।

গোনাহগারের গিবত

অমুক ব্যক্তি যিনা করেছে, গিবত করেছে, অথবা সে অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ, অন্তরে সীমাহীন শত্রুতা রাখে, অথবা সে মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত, অমুকে মা- বাবাকে অত্যন্ত কষ্ট দেয়, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে, অথবা অমুক ব্যক্তি কটুভাষী, অশ্লীলভাষী, অমুক সর্বদা মদ পান করে, অধিকাংশ সময় চুরি করে কারো ব্যাপারে এ ধরনের কথা। বলাও গিবত।

ইবাদতে গিবত

অমুক ভালোভাবে নামায আদায় করে না, তাহাজ্জুদ পড়ে না, নফল নামায পড়ে না, রমযানুলমুবারকের রোযা আদায়ে ত্রুটি করে, অথবা মাকরুহ ওয়াক্তে নামায আদায় করে এসব বলা ইবাদত সম্পর্কিত গিবত।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় এক লোক আরেক লোকের সম্পর্কে বললো, 'আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে অমুকের সাথে শত্রুতা রাখি।' যার সম্পর্কে এরূপ বলা হলো, তিনি জানতে পেরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, 'হে আল্লাহর রাসুল! অমুক আমার গিবত করেছে এবং আমার সাথে শত্রতা পোষণের কথা বলেছে। আপনি এর ফয়সালা করুন।' রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি কেনো অমুকের প্রতি শত্রুতা পোষণ করো?' তিনি বলতে লাগলেন, 'আমি তার প্রতিবেশী। সে পাঁচ ওয়াক্ত ব্যতীত অন্যকোনো নামায পড়ে না। রমযানের রোযা ব্যতীত অন্যকোনো নফল রোযা রাখে না। ফরয। যাকাত ব্যতীত কখনো সদকা দেয় না। এসব কারণে আমি তার সাথে শত্রুতা পোষণ করি।' যার গিবত হয়েছে, করা তিনি উল্লিখিত অভিযোগসমূহের কথা শুনে বলতে লাগলেন, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ! তাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি কী কোনো ফরয আদায়ে ত্রুটি করি?' রাসুলুল্লাহ। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গিবতকারীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, 'সে ফরযসমূহ। আদায়ে কোনোপ্রকার ত্রুটি করে না, যেহেতু সে নফল ইবাদত করে না, তাই আমার অন্তর তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে।' রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ঘটনা শুনে ওই সাহাবিকে বললেন, 'তুমি কী জানো, হতে পারে তুমি যার সম্পর্কে একথাগুলো বলছো, সে তোমার থেকে উত্তম। অতএব, তার গিবত করা এবং তার সাথে শত্রুতা পোষণ করা তোমার জন্য সমীচীন নয়।"

আরো পড়ুন: হালাল ও হারাম উপার্জন হারাম উপার্জন থেকে দান করা ও অপরের অধিকার হরণ 

কানের গিবত

কারো গিবত শুনে চুপ থাকা এবং তা প্রতিরোধ না। করা কানের গিবত। কেননা, গিবত শুনে চুপ থাকা এবং প্রতিরোধের চেষ্টা না করা যেনো নিজেই গিবত করা।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

যখন কারো গিবত করা হয়, আর তুমি যদি সে মজলিসে উপস্থিত থাকো, তখন তুমি গিবতকৃত। ব্যক্তির সাহায্যকারী হও। তা এভাবে-তুমি তার প্রশংসা শুরু করে দাও, যাতে মানুষ তার গিবত হতে বিরত হয় এবং গিবতকারীকে একাজ হতে নিষেধ করো। নতুবা নিজে এ মজলিস থেকে চলে যাও। কেননা, চুপচাপ বসে থাকলে তুমিও গিবতকারী গণ্য হবে। ১

হযরত শেখ সাদি রহ. বলেন-

'যে সত্তা তোমাকে চোখ, মুখ ও কান দান করেছেন, যদি তুমি বুদ্ধি বিবেকসম্পন্ন হও তবে এগুলো তাঁর ইচ্ছার বিপরীতে ব্যবহার করো না।

অন্তরের গিবত

অন্তর ও মনের মাধ্যমেও গিবত হতে পারে। কারো প্রতি কোনো দলিল-প্রমাণ ছাড়া খারাপ ধারণা পোষণ করা গিবতের অন্তর্ভূক্ত। অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত। অযথা কারো প্রতি মন্দ ধারণা রাখা আমাদের সমাজের ঘৃণিত একটি রোগ। মুখে মুখে বলতে পারে না, মানুষের সামনেও প্রকাশ করতে অক্ষম তখন মনে মনে খারাপ ধারণা করে থাকে।

কলম দ্বারা গিবত

কলম দিয়েও গিবত করা যায়। কারো ব্যাপারে চিঠি লিখে কাউকে দোষ জানানো। কারো দোষত্রুটি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা কিংবা লিফলেট-ব্যানার অথবা স্বতন্ত্র গ্রন্থ প্রণয়ন করা-এসবই কলমের গিবত।

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা ইশারা করে গিবত করা

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজের রাতের ঘটনা বর্ণনাকালে বলেন, আমি জাহান্নামে দেখলাম, একদল নারী ও পুরুষকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, আমি হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম-কে তাদের শাস্তির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, 'এরা ওইসকল লোক যারা দুনিয়ায় মানুষকে চোখ ও হাত দ্বারা ইঙ্গিত করে কষ্ট দিতো। এদের সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

'প্রত্যেক হুমাযা এবং লুমাযার জন্য রয়েছে ওয়াইল নামক জাহান্নাম।'

(শুয়াবুল ইমান, হাদিস নং: ৬৩২৬)

هُمَزَة এবং لُمَزَةَ অর্থ সম্পর্কে তাফসিরবিদদের মাঝে মতোবিরোধ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মত হলো, হুমাযা দ্বারা ওই ব্যক্তি উদ্দেশ্য, যে চোখ এবং হাতের ইশারায় মানুষকে কষ্ট দেয়। আর লুমাযা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যে মানুষকে মুখের দ্বারা কষ্ট দেয়।

তাফসিরে দুররে মানসুরে আল্লামা জালালুদ্দিন সুযুতি রহ. তানযিলে উদ্ধৃত করেছেন, হুমাযা ওইব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, যে মুখে মানুষকে ভর্ৎসনা, তিরস্কার করে। আর লুমাযা সে, যে চোখে ইঙ্গিত করে মানুষকে কষ্ট দেয়। তাফসিরে জালাইনের টিকায় ইবনে কায়সানের সূত্রে উদ্ধৃত আছে, হুমাযা সে, যে নিজের বন্ধু- বান্ধবকে মুখে কষ্ট দেয়, আর লুমাযা সে, যে ভ্রূ দ্বারা কারো প্রতি ইঙ্গিত করে।

আরো পড়ুন: কোরবানি কি কোরবানির পশু জবাইয়ের নিয়ম ও পশু জবাইয়ের দোয়া 

গিবতের ক্ষতিকর দিক সমূহ

  • দুআ কবুল হয় না
  • নেক আমলগুলো কবুল হয় না।
  • আমলনামা থেকে নেকি কমে যায়
  • আমলনামায় পাপ বৃদ্ধি পায়
  • কিয়ামতের দিন হিসাব কঠিন হবে
  • গিবতের ফলে স্ত্রীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হয়
  • গিবতকারী নিজের গোশত ভক্ষণ করবে
  • কিয়ামতের দিন নিজের শরীর নখ দ্বারা আঁচড়ানো
  • জান্নাতে সকলের পরে
  • গিবতকারীর খুজলি হবে
  • কবরের আযাব বৃদ্ধি পাবে
  • গিবতের অপর নাম মুনাফিক
  • গিবতকারীর বিশ্বস্ততা হারিয়ে যায়
  • গিবতের অপর নাম জুলুম
  • গিবতে শয়তান খুশি হয়
  • গিবত আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণের নামান্তর
  • গিবত রাসুলেরও অসন্তুষ্টির কারণ
  • গিবতে রোযা মাকরুহ হয়
  • গিবতের কারণে রোযা কবুল হয় না
  • গিবত হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি করে
  • গিবত অন্যের গোপন বিষয় প্রকাশ করে দেয়

গিবত থেকে বেঁচে থাকার উপকার

গিবত থেকে বেঁচে থাকার সবচে' অন্যতম ও প্রধান উপকার হলো-আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জন। কারণ, গিবত থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর রওজা মুবারকে যখন এ সংবাদ পৌছে অমুক লোক গোনাহ করেছে, তখন তিনি দুঃখিত ও চিন্তিত হন। পক্ষান্তরে তার নিকট কারো পুণ্যকাজের সংবাদ পৌঁছলে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। আর কারো গিবতের সংবাদে তাঁর মন একেবারেই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে মানুষের গিবত পরিহারের সংবাদে তিনি অত্যন্ত খুশি হন।

গিবত পরিহারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকার হলো মুসলমানের গোশত ভক্ষণ করা থেকে নিজেকে হিফাযত করা। কারণ, গিবত মুসলমানের গোশত ভক্ষণের সমতুল্য। এ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত। ঘটনা নিম্নরূপ একবার রাসুলুল্লাহ সা. কয়েকজন ব্যক্তিকে খিলাল করার নির্দেশ দিলেন। তারা বললেন, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ! আজ আমরা কিছুই খাইনি, সুতরাং খিলাল করার কোনো প্রয়োজন নেই।' রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, 'আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের দাঁতে ওই ব্যক্তির গোশতের লালিমা। দেখতে পাচ্ছি তোমরা যার গিবত করেছো। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url